Menu Close

“আমি যখন স্পেন, ইরান ও জাপানে ঘুরতে গিয়েছিলাম তখন আনন্দ ও দুঃখ মিলিয়ে নানারকম অভিজ্ঞতা হয়েছিল”।

হুগা আমীর তাঁর জীবনের নানাধরনের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। তাঁর বাবা ছিলেন ইরানি এবং মা স্পেনীয়। তিনি তাঁর জীবনের কিছু বছর স্পেন এবং ইরান দুই জায়গাতেই কাটিয়েছেন। তারপরে কীভাবে তিনি জাপানে পৌঁছান ও জাপানকেই তাঁর ঘর বানান, কৃষ্ণমূর্তীর শিক্ষার সাথে কীভাবে তাঁর যোগাযোগ হয়েছিল এইসব নিয়েই তাঁর এটি একটি অসাধারণ গল্প।

খুব ছোটবেলা থেকেই নানা দেশের নানা জায়গার কালচারের বা শিক্ষার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় এবং বিভিন্ন পরিবেশের মধ্যে দিয়ে বড় হয়ে উঠি, নানা জায়গায় ঘোরার মধ্যে দিয়েই আমার ছোটবেলা কেটেছে। আমার মনে পড়ে, যখন আমার দশ বছর বয়স তখন ইরান থেকে স্পেনে প্লেনে আমি একাই যাই।

আমার মনে পড়ে, ছোটবেলা থেকেই আমার কোন কিছুর প্রতিই টান ছিল না, তার ফলে আমার মনের ভিতর কোন বাঁধন ছিল না এবং তাই সবসময় খুব খোলা মনেই ঘুরে বেড়াতাম। একজন ইরানি বাবা এবং স্পেনীয় মায়ের লালন-পালনে আমার ছোটবেলা নানাধরনের অভিজ্ঞতায় ভরে ওঠে। দুঃখ ও কষ্টের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা হয়। আমি আমার বাবা-মা, ঠাকুরদা-ঠাকুমা এবং দূরসম্পর্কের আত্মীয় স্বজনদের লালন-পালনে বড় হয়ে উঠি, খুব কম করে বললেও বলতে হয় যে আমার বড় হয়ে ওঠা সুখ, দুঃখ, হাসি-কান্নায় ভরা ছিল।

আমার ছোটবেলায় দুই বছর আমি ইরানে ছিলাম। একটা যুদ্ধ একটা দেশের উপর যে ভয়ের পরিবেশ ও আঘাতের চিহ্ন ছেড়ে যায় আমি সেখানে তা দেখেছিলাম। পুর ১৯৮০ –র দশক ধরেই ইরাকের সাথে এই দেশের যুদ্ধ চলেছিল। সত্যিকারের ধর্মীয় চেতনা জাগানোর ব্যাপারে ধর্মীয় সংস্থাগুলির কিছুই করার ছিল না যদিও এইসব ব্যাপার বোঝার পক্ষে আমি খুবই ছোট ছিলাম।

আমার ১৩ বছর বয়সে আমি আবার ফিরে আসি ইরানে এক বছরেরও বেশী সময় এখানে থাকার উদ্দেশ্যে। এটা ছিল আমার জীবণের সবচেয়ে কঠিন সময় কারণ আমি যে ইরানকে চিনতাম তা সম্পূর্ণরূপে বদলে গেছিল। এখানকার আবহাওয়া এবং খাদ্য আমার সহ্য হচ্ছিল না, তার উপরে ছিল এখানকার ধর্মের দমবন্ধকরা শিক্ষা।

সেই প্রথম আমি লক্ষ করেছিলাম সেখানে কীভাবে মানুষের বুদ্ধি পরিবর্তন করা হয়, কিছু মতবাদ তাদের উপর চাপিয়ে দিয়ে কীভাবে একজনের মনকে সংকুচিত করা যেতে পারে। দিনের পর দিন আমার সতেজ মন ও আমার শক্তি ভেঙ্গে পড়ছিল এবং এই দুঃস্বপ্ন থেকে বেরোবার ইচ্ছা আমার প্রত্যেক দিনের স্বপ্ন হয়ে উঠেছিল।

মনগড়া ধর্মের শাসন দিয়ে একটি সমাজকে দঃখ দুর্দশার দিকে ঠেলে দেওয়া এবং সেই পরিবেশ ছোট ছোট বাচ্চাদের মনে কীভাবে জায়গা করে নেয় তা আমি আমার নিজের জীবনেই লক্ষ করি এবং অভিজ্ঞতা লাভ করি। সেই সময়, বাচ্চা হিসাবে আমার ইচ্ছা হত যেখানে আমি স্বাধীনতা পাব সেখানে ফিরে যেতে। সেটা ছিল স্পেন যেখানে আমি আমার ছোটবেলার বেশীরভাগ বছরগুলিই কাটিয়েছি। আমার ঠাকুরদাকে অনেক ধন্যবাদ জানাই কারণ তার চেষ্টাতেই আমি স্পেনে ফিরে যেতে পেরেছিলাম।

স্পেনে থাকার সময় আমার ছোটবেলায় এবং বিশেষ করে কৈশোরে চীন, জাপান এবং মার্শাল আর্টস (কারাতে)-এর প্রতি আমি একটা টান অনুভব করি। কিছু বছর পরে আমার এই ভালোলাগা জাপানের প্রতি ঘুরে যায়। আমার মনে আছে, আমার  দিদিমার কাছে যে বইগুলি ছিল তার মধ্যে যখন কামাকুরা-বুদ্ধার ছবিগুলির দিকে তাকাতাম তখন আমার গায়ে শিহরণ জাগত এবং সেইগুলি স্বপ্নেও দেখতাম।

সেই সময় আমার মন এমন একটা কিছু খুঁজত যা অন্যদের থেকে আলাদা। যখন আমার ১৪ বছর বয়স তখন এই মানসিকতাই সূর্য ওঠার দেশ জাপানের সাথে প্রথম আমার যোগাযোগ করিয়ে দেয়। স্পেনে ফেরার পরে আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম যে একদিন আমি জাপানে বসবাস করব এবং মার্শাল আর্টস অভ্যাস করব।

আমার ছোটবেলার শেষের দিকে আমি মার্শাল আর্টস অভ্যাস করতে শুরু করি কিন্তু এ সবের উপরেও একটা জিনিষ ছিল যা আমাকে জাপানের মূল্য ও সারমর্ম বুঝিয়ে দেয়, সেটা হল আইকিডো। এইটি আমার উপর যে শুধু মানসিকভাবেই বিরাট প্রভাব ফেলেছিল তা নয় শারীরিকভাবেও তেমনই ফেলেছিল এবং এইটি অভ্যাস করার ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণভাবে মন প্রাণ ঢেলে দিয়েছিলাম।

যখন আমি আইকিডো নিয়ে পড়াশোনা করছিলাম তখন অনুভব করেছিলাম যে যদিও এটি জাপানের একটি মার্শাল আর্ট,তবু এর প্রয়োজনীয়তা হল “মহাবিশ্বের সাথে সুর মিলিয়ে এক হয়ে যাওয়া” যা  সকলের চেতনার সাথেই এক হয়ে যায়, কোন দেশ বা পতাকার অন্তর্গত নয় শুধু একজন সম্পূর্ণ মানুষ হওয়া।

আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বছরগুলিতে আমি জাপানে ঘুরতে যেতাম এবং তাদের ভাষা ও নানাধরনের শিক্ষা ও শিল্প নিয়ে খুব গভীরভাবে চর্চা করতাম। সেখানকার মাঙ্গা গল্প, এনিমে এবং জনপ্রিয় যুব সংস্কৃতি আমাকে মুগ্ধ করেছিল। প্রায়ই জাপানে ঘুরতে যাওয়াটা ছিল সেখানে স্থায়ীভাবে থাকার প্রস্তুতি।

সেই সময়েই আমি জিড্ডু  কৃষ্ণমূর্তির সম্পর্কে জানতে পারি। তাঁকে ভিডিওতে দেখে ও তাঁর সম্বন্ধে পড়াশোনা করার ফলে আমার জীবনে পরিবর্তন আসে, তিনি আমার চিন্তাধারার পরিবর্তন করে দেন, এই মানুষটি যা বলতে চাইতেন তা জানার জন্য দিনের পর দিন, রাতের পর রাত একনাগাড়ে আমার আগ্রহ বেড়েই যাচ্ছিল। কৃষ্ণমূর্তির কথা শুনে এবং তাঁর সম্বন্ধে পড়াশোনা করে একটি অল্পবয়সী ছেলের হৃদয়ে যে অনুভূতি হয়েছিল তা তাঁর পক্ষে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি, এর মানে নুতন একটি জগৎ  আবিষ্কার করা ও তাকে উপলব্ধি করা। আমার এই আগ্রহই জোড় করে আমায় চিন্তার অতীত এক জায়গায় নিয়ে যায় যতক্ষণ না আমি সেই মুহূর্তে পৌঁছাই এবং অনেক জিনিষ আবিষ্কার করি যা আমি কোনদিন ভাবতেও পারিনি এবং আমার জীবনে তা কখনও ঘটেনি, ততক্ষণ অবধি এর থেকে আমার মন সরাতে পারিনি।

সেগুলো কোন মতবাদ ছিল না, এটা কোন ধর্মের বা একজন রক্ষাকর্তার বা গুরুর গতানুগতিক জ্ঞানের কথা ছিল না, যা এতদিন ধরে সবাই শুনে এসেছে। তাঁর বাণীর মধ্যে এমন কিছু ছিল যার প্রত্যেকটি শব্দ নিজেই খাঁটি, উন্নতিশীল ও জীবনের মূল কথা। কৃষ্ণমূর্তির শিক্ষা গ্রহণ করার ব্যাপারে আমার দিক থেকে কোন বাধা ছিল না, কারণ আমি অনুভব করেছিলাম যে ওনার শিক্ষাগুলির মধ্যে যে খাঁটি তথ্য এবং সত্য ছিল যেগুলি আমি আমার রোজকার জীবনে, আমার মনের গভীরে ও বাইরের জগতের অন্যদের সাথে আমার সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে যাচাই করে নিতে পারি।

আমি জাপানে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য চলে যাই। আমার স্নাতকত্ব লাভের পরে  জীবনের আরও  নানারকম ঘটনার মধ্যে এই ঘটনাটি একটি, ইতালিতে একজন শিক্ষকের সাথে আমার হঠাৎ একটি সাক্ষাৎকারের সুযোগ হয় যিনি তাঁর শিক্ষার শেষ বছরে আইকিডোর প্রতিষ্ঠাতা সম্বন্ধে চর্চা করেন এবং তাঁর সেবা করেন।  সেখানে বসবাস করার মত ব্যবস্থা করার পর আমি আমার কৈশোরের স্বপ্নকে একভাবে পূরণ করতে পেরেছিলাম এবং সেই সময়ই আমি আত্মাকে, মনের গভীরতম রহস্য এবং আইকিডোর সারমর্ম বুঝতে পারি।

কৃষ্ণমূর্তি এবং আইকিডো দুইজনেই যা বলেছেন বিশেষত মনের গভীরের রহস্য সম্বন্ধে, পূর্ণ মনসংযোগ সম্বন্ধে, নিজের এবং অন্যের অনুভুতির চেতনা, মহাকাশের সাথে আমাদের সম্পর্ক, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ও মহাবিশ্বের সাথে সম্পর্কের, আমি এই ব্যাপারে দুজনের কথার মধ্যেই একটি মিল খুঁজে পাই। মানুষের মধ্যে যে ক্ষুদ্র বিশ্ব আছে তার সাথে মহাবিশ্বের একটা নিবীড় সম্পর্ক আছে,আইকিডোর কথার সারমর্ম সেটাই।

আইকিডোর ভক্ত হওয়া সত্ত্বেও এবং জাপানের এই অংশে থাকার ইচ্ছা থাকলেও এখানে বসবাস করা খুব একটা সহজ ছিলনা। সামুরাইয়ের আন্তরিকতা ও শক্তি এবং তার পাশাপাশি সহানুভূতিশীল জেন মাষ্টারের যেমন জ্ঞান তেমনি তার নিষ্ঠা ও নিখুঁত কার্যকলাপের মধ্যে এমন কিছু ছিল যা আমাকে মুগ্ধ করত। এখানকার শিল্প থেকে আরম্ভ করে প্রতিদিনের কাজকর্ম এবং সামাজিক নিয়ম সবই এই পৃথিবীর অন্য সব জায়গার তুলনায় খুবই আলাদা ধরনের, প্রথমেই যেটা  চোখে পড়বে সেটা হল এখানকার অনুপ্রেরণার উৎস ও নিরাপত্তা যেটা জাপানের বিশেষত্ব। কিন্তু এই পৃথিবীর অন্যান্য জায়গার মতই জাপানও তার ভাল জিনিষগুলির সারকথা ভুলতে বসেছে।

ইরান এমনকি স্পেনেও যে সামাজিক বিশৃঙ্খলতা চলছে, যে কেউ বাইরের থেকেই বুঝতে পারবে, আর অন্যদিকে যেমন উত্তরদিকের ইউরোপীয় দেশগুলো অথবা এক্ষেত্রে, বিশেষকরে জাপানের সামাজিক বিশৃঙ্খলতা বাইরের থেকে কিন্তু বোঝা বেশ কঠিন কারণ সাধারনভাবে দেখলে প্রত্যেকটি ব্যবস্থা সঠিক ও ভালভাবেই চলছে বলে মনে হবে। কিন্তু বেশ কিছু বছর এখানে থাকলে তবেই এখানকার সমাজের ভেতরকার বিশৃঙ্খলতা ও মানুষের মনের বিশৃঙ্খলতা অনুভব করা যায়।

অবশ্যই শারীরিক নিরাপত্তা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং কোন সন্দেহ নেই যে জাপানি সমাজ ব্যবস্থার তা আছে, যেটা ওদের জীবনযাত্রা খুবই আরামদায়ক করে তুলেছে। কিন্তু কেউ যদি রাস্তায় বেরিয়ে দেখে তবে তার খুব কম লোকই চোখে পড়বে যারা তার নিজের চারিদিকের ব্যাপারেও নজর রাখে এবং অনুভূতিশীল বা যে হাসছে, সূর্যাস্ত দেখে আনন্দিত হচ্ছে, পাখিদের গান শুনছে বা দেখছে বড় বড় গাছের পাতায় সন্ধ্যার ঠাণ্ডা হওয়া কেমন আদর করে যাচ্ছে অথবা বন্ধুদের সাথে কথাবার্তায় আনন্দে মেতে উঠছে। এই বিরাট চিন্তাভিত্তিক জীবনযাত্রা, অনুভূতিশীল মানুষের জন্য খুব কম জায়গাই ছেড়ে রেখেছে। যা আরও অনেক যন্ত্রের মত ও রোবটের মত মানুষ তৈরী করছে, যারা শুধু নিজেরটাই বোঝে, হৃদয় দিয়ে মন দিয়ে দেখতে ও শুনতে পারেনা। আমার কাছে জীবনকে বোঝার প্রধান তিনটি শিল্প হল শোনা, দেখা এবং তার সঙ্গে শেখার শিল্প, একজনের পক্ষে অনেক কিছুই শেখা সম্ভব যদি তার মধ্যে প্রকৃত নম্রতা বোধ থাকে।

জাপানি সমাজে, শিক্ষা সেইসব লোকেদের তৈরী করে যারা অন্যদের মত হতে চায়, যারা অনুকরণে এবং শিল্প-জগতের তথাকথিত নামকরা লোকেদের মত হওয়ার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা চায়। কী লাভ এই শিক্ষার যা একজনকে প্রকৃতির সাথে এবং বাকী সব মানবিকতার সাথে প্রকৃত সম্পর্ক তৈরী করতে সাহায্য করে না? প্রকৃত কর্ম অবশ্যই সচেতনার সাথে হতে হবে। দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, জাপানে কোম্পানি এক ধরনের ধর্ম হয়ে গেছে এবং মার্শাল আর্টের প্রকৃত চেতনা এখন তীব্র প্রতিযোগিতায় পরিবর্তিত হয়ে গেছে।

জাপানে বেশ কিছু ভাল লোকের সাথে আমার আলাপ হয় এবং একসঙ্গে কাজও করেছিলাম,শুধু যে কোম্পানি অথবা স্কুলগুলির সাথেই কাজ করেছিলাম তা নয়, সাধারনত যা হয়ে থাকে, সেইসব ক্ষেত্রেও, যেখানে বিশেষ চাহিদাযুক্ত বয়স্ক বা বাচ্চাদের সাহায্য করার জন্য যে সব সংস্থা রয়েছে তাদের সঙ্গেও কাজ করেছি। এটাই সেই জায়গা যেখান থেকে আমি সবচেয়ে বেশী শিখেছি, শিখেছি বাচ্চাদের থেকে এবং বড়দের থেকে, কারণ একজন অনেক শিক্ষা পেতে পারে যদি সে জানে কীভাবে মনযোগ সহকারে শুনতে হয়। আমি খুব ভাগ্যবান যে এখানে থাকাকলীন বর্তমানকালের জীবন সম্বন্ধীয় শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের মধ্যে একজনের সাথে আমার আলাপ হয়,তিনি হলেন অধ্যাপক কানামোরি তোশিরো, একজন মহান বন্ধু, দূর্ভাগ্যক্রমে সম্প্রতি তিনি এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন।

ছোট ছোট বাচ্চারা আমার জীবনের অন্য একটি অংশ, সেখানে যারা আমার ছাত্র তাদের সাথেই আমি সবথেকে বেশি আনন্দ পেয়েছি। যখনি আমি কোন খারাপ অবস্থায় পড়েছি তখনই বারবার এইসব বাচ্চাদের থেকে আমি উৎসাহ এবং শক্তি পেয়েছি। বাচ্চাদের সাথে ভালোভাবে মিশলে যে কেউ বাচ্চাদের থেকে অনেক কিছু শিখতে পারে। বাচ্চাদের শুদ্ধতা, উৎসাহ, নির্মল আনন্দ, তাদের ভালো এবং অল্প ভালোত্ব যেটা তাদের খুব ছোটবেলা থেকেই থাকে, তার থেকেও অনেক কিছু শেখা যায়। তুমি আন্তরিকভাবে যদি বাচ্চাদের সাথে মিশতে পার তবে তোমার মনের গভীরে যা চাপা পড়ে আছে তা বাচ্চারা বের করে নিতে পারে। এ ছাড়াও কেউ যদি তাদের প্রতি পূর্ণ মনযোগ দেয় এবং তাদের হৃদয়ের সংস্পর্শে আসে তখন সেও অনুভব করে যে বাচ্চারা সাধারণত ভাষায় বলা যায় না এমন একটা অবস্থাতেই থাকে যেটা কোন চিন্তা নয়। যেটা তাদের সকল জিনিষকে দেখতে এবং অনুভব করতে সাহায্য করে, এ ব্যাপারে বড়রা তাদের বহু বছরের চেষ্টাতেও এই অবস্থায় আসতে পারে না। এই অর্থে বাচ্চাদের সাথে স্বাভাবিকভাবে হৃদয় দিয়ে মিশে আমি সারাজীবন ধরে অনেক শিক্ষা পেয়েছি।

আমাদের নানারকম দূষিত প্রভাব সত্ত্বেও বাচ্চারা এই পৃথিবীর সম্পদই রয়ে গেছে, এই পৃথিবীকে পরিবর্তন করার একটাই মাত্র রাস্তা আছে তা হল শিক্ষাক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে এই বাচ্চাদের সাথে নিবীড় সম্পর্ক গড়ে তোলা, যা প্রকৃত মানুষের প্রজন্ম তৈরী করবে। সতেজ মনের চরিত্র এবং অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা গড়ে তুলতে হবে সরাসরি জীবনের সাথে এবং তারা যেখানে বাস করে সেই পরিবেশের সাথে সম্পর্কের দ্বারা, কোন সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ (ম্যানুয়াল) বা বইয়ের দ্বারা নয়।

এরপরে আমি আমার শেষ সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলাম, সেটা হচ্ছে, যে দুটো দেশের জাতীয়তা আমার ছিল, স্পেনীয় এবং ইরানি, দুটোই আমি ছেড়ে দেব। আমাকে জাপানের জাতীয়তা দেওয়া হয়েছিল ১২ বছর বাদে। কিন্তু এটাই আমার চাওয়া ছিলনা, কারণ খুব ছোট বয়স থেকেই কোন দেশের জন্যই আমি কখন কোন টান অনুভব করতাম না কিন্তু আমার কাজের সুবিধার জন্য এবং ভালোভাবে তা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এটা আমি চেয়েছিলাম। এই জায়গাটাকেই আমার সঠিক জায়গা বলে মনে হত।

অসহ্য চাপের মধ্যে পড়ে বহুবার কষ্ট পেয়েছি, যখন কেউ আমার পাশে ছিল না তখন একা থাকার যন্ত্রনায় বহুবার কেঁদেছি এবং বারবার শারীরিক ও মানসিক অক্ষমতার জন্য বাধাপ্রাপ্ত হয়েছি। অবশেষে এক নূতন দরজা খুলতে বা আবিষ্কার করতে পারি যা সবসময়ই সেখানে ছিল। জাপানের জাতীয়তা পাওয়ার পরও আমি কেঁদেছিলাম, তবে সেটা একটা নূতন দেশের পাসপোর্ট পেয়েছিলাম বলে নয় কিন্তু তার কারণ হল এত সব ঘটনার মধ্যে দিয়ে আমি নিজের ভেতরকার উন্নতির জন্য যে যাত্রা শুরু করেছিলাম তা শেষ করার জন্য।

শিক্ষক আইকিডোর সাথে আমার আইকিডো মক্কায় থাকার ঠিক দশ বছর পরেই ফুকুশিমার খুব কাছেই যে পারমানবিক শক্তি কেন্দ্র আছে সেখানে ২০১১ সালে যে ভূমিকম্প হয় এবং তার বিকিরণ ছড়িয়ে পড়ায় সেখানে যে ভয়ঙ্কর অবস্থা হয়, তার অভিজ্ঞতা হয়। তখন আমার জীবনে একটা পরিবর্তনের প্রয়োজন অনুভব করি এবং সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলি। ২০১৮ সালে জাপানের একদম উত্তরদিকে খুব কম জনবহুল একটি দ্বীপ যার নাম হক্কাইডো সেখানে চলে যাই। এইখানেই বর্তমানে আমি মার্শাল আর্টস এবং ডোজো নামে একটি জিম পরিচালনা করি এবং তার সাথে বিশেষভাবে-সক্ষম বাচ্চাদের আমি দেখাশোনা ও কিন্ডারগারটেনের শিক্ষক হিসাবে কাজ করি।

আমি যে হুগা নামটি ব্যবহার করি তার মানে এবং ডোজো-র মানে একই, আক্ষরিক অর্থে বলতে গেলে দুটো নামেরই মানে “সূর্য দর্শন”। আমি আশাকরি, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লব হবে তখনই যখন শৈশবের শুদ্ধতা ও সূর্যের সৌন্দর্য আমরা একসাথে অনুভব করে চলতে পারব। এর জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম হবে শিক্ষা এবং শিল্প, এটাই সেই জায়গা আমি এখন যেখানে আছি এবং যেখান থেকে আমি আমার জীবনকে নতুন করে শুরু করতে পছন্দ করব। একটি নূতনের শুরু, একটি নূতন ভোর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *