শ্রীমতী সুদেষ্ণা সিনহা একজন অভিজ্ঞতাসম্পন্না শিক্ষিকা। তিনি এখনকার শিক্ষার অসারতা অনুধাবন করেন। তিনি বলেন এ ব্যাপারে কোনও সুরাহা হচ্ছে না। এই শিক্ষা ব্যবস্থায় বাচ্চারা নানা প্রকার ভীতি ও নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হচ্ছে, যদিও এই শিক্ষা ব্যবস্থা বাচ্চাদের এইসব মানসিক ব্যাপারগুলিতে খুব সামান্যই সাহায্য করছে। কেন? এ ব্যাপারে কী করা যেতে পারে?
সুদেষ্ণা সিনহা
আজকাল অনলাইন অথবা অফলাইনে বাচ্চাদের আমরা খুব সহজেই অঙ্ক, বিজ্ঞান অথবা ভূগোল, রোবটিক্স এমনকি যোগ ব্যায়াম এবং কোডিং শিখাতে পারি। কিন্তু তাদের হাতাশা, অকৃতকার্যতা, উদ্বেগ, ভয় এবং নিরাপত্তাহীনতার কী হবে? আমরা কেন তাদের এই সব ভয়ংকর মানসিক অবস্থাগুলিকে তাদের সাধারণ শিক্ষা সংস্কৃতির বিষয়গুলির মতই গ্রহণ করার ব্যাপারে শিক্ষা দিতে পারিনা ?
এই মহামারীর সময় শিক্ষার এই অসারতা কি আরও বেশী করে প্রকট হয়ে উঠছে না? এক বছরেরও বেশী হয়ে গেল বাচ্চারা অনলাইন ক্লাস করছে অথবা কোন ক্লাসই করছে না। প্রাক মহামারীর সময়ের মত তারা আর তাদের প্রিয় সহপাঠীদের সাথে মিশতেও পারছে না, একসঙ্গে সবাই মিলে হাসি-খেলায় মেতে উঠতেও পারছে না। এর উপরে আবার হয় তাদের পরিবার করোনা আক্রান্ত নয়ত লক–ডাউনের জন্য তাদের মা-বাবারা কাজ হারিয়েছেন। এখন এই সব বাচ্চারা আর আগের মত বাইরে বেরতে পারছে না, পার্কে গিয়ে খেলা করতে পারছে না। একটা বদ্ধ পরিবেশের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।
বিশেষ করে শহরাঞ্চলের প্রত্যেক স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে যে বিশাল মানসিক শূন্যতা তৈরী হচ্ছে সেই ব্যাপারে কেউ কি বুঝছে? আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এমন কিছু কি তৈরী করা হয়েছিল যা এই সব শিশুদের জীবনের একাকীত্ব, হতাশা, নিরাপত্তাহীনতা এবং মানসিক ভারসাম্যহীনতা থেকে তাদের উদ্ধার করতে পারে, যেটা আজ অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে সহজেই করা যেতে পারত। কিন্তু হায় !
করোনাকালীন সময়ের আগেই হোক অথবা বর্তমান মহামারীর সময়েই হোক, বাচ্চাদের উপর ভীতির বিস্ফোরণ হয়েই চলেছে। প্রিয়জনদের হারানোর ভয়, মধ্যবিত্ত শ্রেণীভূক্ত হয়ে যাওয়ার ভয় এবং সহপাঠীদের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয় ইত্যাদি নানারকমের ভয়ে তারা ভীত। আমরা কি বুঝতে পারছি একটি বাচ্চার মনের উপর ভয় ও নিরাপত্তাহীনতা কীরকম বিরূপ প্রভাব ফেলে? এটাই কি যথাযথ সময় নয় যখন আমরা বাচ্চাদের এই ভীতি ও নিরাপত্তাহীনতা থেকে মুক্ত করার উপায় চিন্তা করে এবং এইগুলিকে শিক্ষা প্রক্রিয়ার অংশ করে নিয়ে তাদের এই ব্যাপারে সাহায্য করি ?
আজকের যুগে শিক্ষাগত যোগ্যতার চাহিদার সাথে সাথে লোভ, ভয়, হতাশা, নিরাপত্তাহীনতা এবং এইরকম আরও সব আবেগের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যও বাচ্চাদের গড়ে তোলা কি উচিত নয়? সমস্ত স্কুল সম্প্রদায়ের (বাবা-মায়েদেরও) এটা কি কর্তব্য নয় যে প্রত্যেকটি বাচ্চার দিকে এ ব্যাপারে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া, নাকি এটা শুধুই পরীক্ষায় পাশ করা অথবা আরও শংসাপত্র সংগ্রহ করা এবং প্রতিযোগিতায় জেতা ?
যদি সমস্ত স্কুলগুলি বাচ্চাদের এই অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলিকে শিক্ষা ব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে সংযুক্ত করার ব্যাপারে ভাবত, তাহলে তারা আরও সহজেই এই মহামারীর তৃতীয় ঢেউয়ের দুর্ভোগের সাথে যুঝতে পারত। একটি রিপোর্ট কার্ড থেকে একটি বাচ্চার পরীক্ষার নম্বর ও অতিরিক্ত কিছু ক্ষেত্রে সে কতটা দক্ষ তা জানা যায়। কিন্তু আজকের এই রিপোর্ট কার্ড কি পারে একটি বাচ্চার ভয়, নিরাপত্তাহীনতা, হতাশাকে জয় করার ক্ষেত্রে তার কতটা সামর্থ্য বা প্রকৃতির প্রতি তার ভালবাসা কতখানি তার পরিমাপ প্রতিফলিত করতে ?
শিক্ষার ক্ষেত্রে অন্যান্য বিষয়গুলির সাথে, বিশেষ প্রয়োজনীয় কিছু বিষয় সংযুক্ত করার ব্যাপারে কিছু বলতে চাই। যেমন প্রত্যেক দিন বাচ্চারা কিছু মননশীল বা আনন্দদায়ক কার্যকলাপের মধ্যে থাকবে যেটা তাদের আত্মসচেতনতা এবং আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করবে। এটা করার সময় কঠোর শাসন ব্যবস্থার প্রয়োজন নেই। বাড়িতে এটা করার জন্য আধঘণ্টা সময় ধার্য করা যেতে পারে। শান্তভাবে কোন বিশেষ উদ্দেশ্য ছাড়াই একা কিছুক্ষণ বসে থাকা যেতে পারে বা ছাদে চুপচাপ কিছুক্ষণ সময় হাঁটা যেতে পারে আথবা শান্তভাবে সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত দেখা যেতে পারে। বাবা-মা অথবা ভাইবোনদের সাথে নিয়েও তা করা যেতে পারে।কোনও গৃহপালিত পশুর খেলাও চুপচাপ লক্ষ করা যেতে পারে বা আকাশে উড়ন্ত পাখীদের দেখেও নির্মল আনন্দ উপভোগ করা যেতে পারে। এই সময়ে কিন্তু তাদের কর্মক্ষমতা, সিলেবাস শেষ করা বা পরীক্ষায় অকৃতকার্যতা নিয়ে বা কোন একটি আদর্শ সম্বন্ধে বোঝানো ইত্যাদি ধরনের এই সব চাপ তাদের উপর সৃষ্টি করা উচিত হবে না।
স্কুলে বা বাড়িতে বাচ্চাদের খুব নমনীয় ভাবে অনুপ্রাণিত করা যেতে পারে। প্রত্যেক দিন কিছু সময় তাদের সঙ্গ দেওয়া, তারপরে তাদের গল্প শোনান, গান বা নাচ করান বা খেলার মাধ্যমে অথবা স্কুলে তাদের সাথে সাধারণ অর্থপূর্ণ সংলাপের মাধ্যমে তাদের সুন্দর মানসিক স্বাস্থ্য গড়ে তোলা যেতে পারে।
এটা তাদের সহানুভূতি বাড়াতে, নিজেদের আত্মমর্যাদা বোধ বাড়াতে এবং মানসিক চাপ থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করবে ফলে তাদের মানসিক অবস্থার উন্নতি হবে।
কিন্তু এই সব কাজই নিতে হবে ধৈর্যের সাথে, সহানুভূতিশীল হয়ে আর ভালবেসে এবং এই কাজে স্কুল শিক্ষকদের সাথে মা-বাবাদেরও সঙ্গে নিতে হবে। তবে এই কাজ করার সময়ে কিন্তু শিক্ষক ও মা-বাবাদের নিজেদের লোভ, উচ্চাকাঙ্খা, নিরাপত্তাহীনতা এবং নিজেদের অসম্পূর্ণ ইচ্ছাগুলিকে ও উচ্চাকাঙ্খাগুলিকে দমন করে এগিয়ে আসতে হবে। গ্রীষ্মকালীন ক্যাম্পে ছোট ছোট দলে বাচ্চাদের নিয়ে গিয়ে কিছু আনন্দদায়ক কার্যকলাপ করিয়ে আমার এই ধারণার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখেছি যে বাচ্চারা প্রত্যেকদিন খুবই আনন্দের সাথে বাড়ি ফিরে যায়। যদিও আমি আমার জীবনের বেশিরভাগ সময়ই স্কুল শিক্ষিকা হিসাবে কাটিয়েছি তবু আমি এই ধারণাটিকে স্কুলের মূল ধারার সাথে যুক্ত করার সুযোগ কখনও পাইনি।
যতক্ষণ না কেন্দ্রীয় সরকার এবং প্রাসঙ্গিক শিক্ষাবোর্ডগুলি শিক্ষা ব্যবস্থার এই অসারতা স্বীকার করছে এবং পাঠ্যক্রমে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের বাচ্চারা বর্তমানের এবং ভবিষ্যতের সম্ভাব্য ভয়ের, নিরাপত্তাহীনতার, হিংস্রতার, লোভের, দুর্নীতির গভীর মানসিক সংকট থেকে রক্ষা পাবে না এবং এই শিক্ষা ক্রমাগত দুর্দশাগ্রস্থ মানসিক অবস্থা সৃষ্টি করতেই থাকবে।
তাই এই ভয়ঙ্কর প্রশ্নটি থেকেই যাচ্ছে যে –
আজ একটি স্কুলের রিপোর্ট কার্ড কি একটি বাচ্চার সত্যিকারের সত্তাকে প্রতিফলিত করতে পারে?
“যে শিক্ষা ব্যবস্থা জীবনের বিশাল অভিজ্ঞতার এবং এর সব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দিকগুলি, এর অসাধারণ সৌন্দর্য, এর দুঃখ, এর আনন্দ বুঝতেও সাহায্য করে না, নিশ্চিত করে বলা যায়, সেই শিক্ষার কোন মানেই হয় না। তুমি অনেক ডিগ্রী পেতে পার, তোমার নামের পাশে অনেকগুলি অক্ষর যুক্ত হতে পারে এবং তুমি একটা ভাল চাকরীও জোগাড় করে নিতে পার। কিন্তু তাতে কী? পরবর্তীকালে যদি দেখা যায় যে তুমি নিস্তেজ, ক্লান্ত এবং বোধহীন হয়ে গেছ, তাহলে এত কিছু করার মানে কী হল?”
– জিড্ডু কৃষ্ণমূর্তি
প্রকৃত শিক্ষা হচ্ছে, কীভাবে চিন্তা করবে তার শিক্ষা, কী চিন্তা করবে তার নয়। যদি তুমি জান কীভাবে চিন্তা করতে হয়, যদি তোমার মধ্যে প্রকৃতই সেই ক্ষমতা থাকে, তবে তুমি একজন মুক্ত মানুষ, সমস্ত মতবাদ, কুসংস্কার ও যাগযজ্ঞ অনুষ্ঠান থেকে মুক্ত এবং তখনি তুমি খুঁজে পাবে ধর্ম কী।
– জিড্ডু কৃষ্ণমূর্তি